Posts Tagged ‘#satyajitray’

রায়বংশীয় বায়সকাহিনী

Posted by Dev Baul - 05/01/24 at 05:01 pm

সত্যজিৎ বংশগতিতে অনেক কিছুর সাথে এক সূক্ষ্ম রসবোধ পেয়েছিলেন তাঁর বাবা আর ঠাকুরদার থেকে| এই রসে আছে চার আনা হাস্য রস, চার আনা অদ্ভুত রস আর আট আনা খেয়াল রস — তৃতীয়টি নবরসের বহির্ভূত আর নিতান্তই সুকুমারের পেটেন্টেড রস| সত্যজিৎ আবার নিজের সৃষ্টিকর্মে উপেন্দ্রকিশোর আর সুকুমার এর লেখা যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন — “গুপী গাইন বাঘা বাইন” উপেন্দ্রকিশোরের গল্প অবলম্বনে আর সুকুমারের “আবোল তাবোল”/“খাই খাই” এর ছড়া থেকে উদ্ধৃতি, আমরা সত্যজিতের লেখা বা সিনেমাতে হামেশাই পাই|

 

কিন্তু আমরা যদি একটি চরিত্র খুঁজি যিনি এই তিন লেখকেরই লেখার মধ্যেই বিদ্যমান — কাক ছাড়া বোধহয় অন্য কোন উদাহরণ পাব না| অনেক পক্ষী বিশারদদের মতে, পক্ষীকুলে কাক সবচেয়ে বুদ্ধিমান পাখি — একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে যে কাকের বুদ্ধি নাকি এক সাত বছরের মানবশিশুর সমান| এবার আমরা একটু দেখি যে রায়বংশের তিন পুরুষের লেখায় কাক মহাশয় কী রূপে এসেছেন|

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

গেরস্ত ভাই, দাও তো আগুন,
গড়বে কাস্তে, কাটব ঘাস,
খাবে গাই, দেবে দুধ, খাবে কুত্তা,
হবে তাজা, মারবে মোষ, লব শিং,
খুঁড়ব মাটি, গড়বে ঘটি,
তুলব জল, ধোব ঠোঁট-
তবে খাব চড়াইর বুক

 

তখন গৃহস্থ এক হাঁড়ি আগুন এনে বললে, ‘কিসে করে নিবি?’

বোকা কাক তার পাখা ছড়িয়ে বললে, ‘এই আমার পাখার উপরে ঢেলে দাও।

গৃহস্থ সেই হাঁড়িসুদ্ধ আগুন কাকের পাখার উপর ঢেলে দিলে, আর সে বেটা তখুনি পুড়ে মরে গেল। তার আর চড়াইর বুক খাওয়া হল না

“টুনটুনির বই” এর “চড়াই ও কাক” গল্পের শেষ কটি লাইন থেকে আমরা উপেন্দ্রকিশোরের কাকের বিদ্যেবুদ্ধির বহর বুঝতে পারি| ইনি নেহাতই নির্বোধ সাংসারিক জ্ঞানহীন এক প্রাণী — তাঁকে বোকা বানাতে মানুষ (কুমোর,কামার), জন্তু(গোরু, কুকুর, মোষ, চড়াই) আর এমন কি নিষ্প্রাণ মাঠ/পুকুর এরও অসুবিধা হয় না| এই গল্পে কাক মহাশয় এক দুষ্টু লোক বা ভিলেন|

সুকুমার রায়

উপেন্দ্রকিশোরের কাকের ঠিক ১৮০ডিগ্রী বিপ্রতীপে আমরা পাই সুকুমারের কাককে| সুকুমারের শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে একজন প্রতিষ্ঠিত হিসাবরক্ষক যিনি হিসাবি/বেহিসাবি, খুচরা/পাইকারি সকল প্রকার ব্যবসার গণনা করে থাকেন|  তিনি হ্যান্ডবিল বিলি করে তাঁর প্রদত্ত পরিষেবার বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন আর  তিনি সময়ের দাম বিলক্ষণ জানেন — ঠিক সময় মত সাত দুগুণে চোদ্দো স্লেটে লিখে ফেলেন, নাহলে সেটা “চোদ্দো টাকা এক আনা নয় পাই” হয়ে যেত| তিনি তাঁর মক্কেলদের বিকল্প বাছার অধিকার দেন — তাঁরা হিসাবটা ত্রৈরাশিকে না ভগ্নাংশে নেবেন| এমন প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য কোন অমানুষ গোত্রের প্রাণীর মধ্যে আমরা বিশ্বসাহিত্যে আর পাব বলে মনে হয়না — অন্তত কর্ভাস এর আবির্ভাবের পূর্বে| “হ য ব র ল” তে শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে এক অন্যতম মুখ্য চরিত্র|  

 

সত্যজিৎ রায়

এবার আসি প্রোফেসর শঙ্কুর সন্তানসম কর্ভাস এর গল্পে| উপেন্দ্রকিশোরের কাক থেকে শ্রীকাক্কেশ্বার কুচকুচে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন| কিন্তু কাক্কেশ্বর থেকে কর্ভাস এর পরিবর্তনকে একটা কালের নিয়ম মেনে বিবর্তন বলা যেতে পারে — যে নিয়মে উত্তরসূরির মেধা পূর্বপুরুষের চেয়ে বেশী হয়| কর্ভাস অবিশ্বাস্য ভাবে অনেক কিছু জানে এবং করে — সে নিজের নাম ইংরেজিতে লিখতে পারে, প্রাইম নাম্বার জানে ইত্যাদি| তার বাকি গুণের ফিরিস্তি দিতে গেলে কর্ভাস গল্পটার বহুলাংশ এখানে লিখে ফেলতে হবে| কর্ভাস এর জ্ঞান এর উৎস কিছুটা জীন আর অনেকটাই অরনিথন| অরনিথন হল প্রোফেসর শঙ্কু আবিষ্কৃত পাখি-পড়ানো যন্ত্র| অরনিথন যন্ত্রটি বৈদ্যুতিক তরঙ্গ দিয়ে পাখির মস্তিষ্কে জ্ঞান ও বুদ্ধি পাঠায়| কর্ভাস অবশ্য অরনিথনের ক্ষমতা কে ছাপিয়ে এক অদ্ভুত মানবসুলভ বুদ্ধি বা হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স অর্জন করে, যেটার পাখির বুদ্ধির সাথে কোন সম্পর্ক নেই|

তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতেই সে অক্লেশে গোঁত খাওয়া ঘুড়ির মতো গাছের মাথা থেকে নেমে এসে বসল আমাদের মারসেডিসের ছাদের উপর| তারপর অতি সন্তর্পণে — যেন জিনিসটার মূল্য সে ভালভাবেই জানে — তার ঠোঁট থেকে তার সামনেই নামিয়ে রাখল আর্গাসের মাইনাস বিশ পাওয়ারের সোনার চশমাটা|

বলা বাহুল্য এই গল্পে কাক আর অন্যতম না, সে এখন প্রধানতম মুখ্য চরিত্র|

উপসংহার

এই তিন লেখকের লেখায় কাকের উত্তরণের দুটো গল্প পাই ১)বোকা থেকে চালাক আর চালাক থেকে জিনিয়াস; ২)ভিলেন থেকে অন্যতম মুখ্য চরিত্র আর অন্যতম থেকে প্রধানতম মুখ্য চরিত্র| অন্যদিক থেকে দেখলে আমাদের সমাজের জ্ঞান যত বেড়েছে, আমাদের কাককে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাও বদলেছে — হয়ত আশেপাশের জীবজগতটাকে আমরা আর একটু সহমর্মিতার সাথে দেখতে শিখেছি| যাই হোক, রায়বাবুরা তিন পুরুষ ধরে কাকের গপ্প বলে আমাদের আনন্দ দিয়েছেন — এটাই বাঙ্গালির পরম প্রাপ্তি| 

 

If you enjoyed this article please consider staying updated via RSS. Links to your own social media pages could be added here.