Archive for May, 2022
সেপারের রবীন্দ্রনাথ
Posted by Dev Baul - 17/05/22 at 04:05 pm
সেপারের রবীন্দ্রনাথ
দেবপ্রতাপ বল
এক মার্কিন ইউনিভার্সিটির বাংলা ভাষার প্রফেসর (জন্মগত গোরা সাহেব) ঢাকায় এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “আপনারা সব সময় বলে থাকেন-এপার বাংলা, ওপার বাংলা। আচ্ছা, এই দুই বাংলার বাইরে যে বিপুলসংখ্যক বাংলাভাষী থাকেন তাদের আপনারা কোন বাংলার বলবেন? আমার প্রস্তাব – তাদের সেপার বাংলার লোক বলা হোক।”
আমি সেই সেপার বাংলার লোক, তাই এই শিবের গীত গাওয়ার প্রয়োজন হলো। ঘটনাক্রমে আমাদের পরিবার তিন পুরুষ ধরে সেপার বাংলায় বা প্রবাসে বাস করছে আর বংশানুক্রমে পরিবারের পুরুষেরা কেরানিগিরি করে এসেছেন। আমার বড় হয়ে ওঠা এই মধ্যবিত্ত পরিবেশে আর মূল্যবোধ নিয়ে। সংসারের নিয়মেই রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয় হল – গীতবিতান, সঞ্চয়িতা, আর গল্পগুচ্ছ পড়ে আর শুনে।
এই রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রথম পরিচয়ের গল্পটা নেহাতই সাদামাটা,আর পাঁচটা বঙ্গসন্তানের বেড়ে ওঠার গল্পের মত। তাঁর সাথে আমার দ্বিতীয় পরিচয় হয় পরিণত বয়সে আর সেটা হয় কিছু অবাংলাভাষীদের মাধ্যমে। এই গল্পটা কিছুটা আলাদা – কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনার বিবরণ।
প্রথম
আমার এক পরিচিত বিদেশি আমাকে একটা কবিরের লেখার ইংরেজি অনুবাদের খোঁজ করতে বলেছিলেন। বইয়ের দোকানে প্রথম যে বইটা হাতে এল, সেটার অনুবাদকের নাম শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! কিছুটা খোঁজখবর নিয়ে জানলাম যে কবিরের লেখা প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ। অনুবাদের গুণাগুণ বা যথাযথতার বিচার আমার ক্ষমতার বাইরে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে দুটো পরভাষা নিয়ে কাজ করেছেন, সেটাই আমার কাছে চরম বিস্ময়কর।
দ্বিতীয়
প্লেনে পুনে-ব্যাঙ্গালোর যাত্রাপথে এক মারাঠি সহযাত্রীর কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের এক নতুন পরিচয় পেলাম। বাঙালি দেখে ভদ্রলোক নিজেই যেচে আলাপ করলেন – একথা সেকথা হতে হতে টেগোর এ এসে ঠেকল। তার পরের এক ঘন্টা ধরে আমি জানলাম যে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম ভারতীয় ICS অফিসার বম্বে প্রেসিডেন্সি তে অনেকদিন কালেক্টার হিসেবে ছিলেন। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর দাদা সত্যেন্দ্রনাথের বাড়িতে বেশ কিছুদিন ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি সন্ত তুকারাম রচিত অভঙ্গ (ভজন) শোনেন এবং ভালোবেসে ফেলেন। সেই ভালবাসা এতটাই গভীর হয় যে, তিনি তুকারাম এর লেখা বারোটি অভঙ্গ বাংলায় অনুবাদ করেন। আবারও অনুবাদ আর এবার মারাঠি ভাষা – আর ও একটি পরভাষা।
তৃতীয়
একবার এক নব্য রবীন্দ্রবিরোধী সর্বজ্ঞর সাথে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়ার ভুল করে ফেলেছিলাম। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী “পুরানো সেই দিনের কথা” নাকি “Auld Lang Syne” থেকে চুরি করা(plagiarized)। কিছুক্ষন এক অর্থহীন বিস্বাদ বিতর্কে সময় কাটিয়ে গুগল নিয়ে বসলাম। জানলাম “Auld Lang Syne” এর আদলে বিশ্বের ষাটটি ভাষায় গানটি লেখা এবং গাওয়া হয়েছে। আমার মত গড়পড়তা বঙ্গসন্তান যার এই স্কটিশ মেলোডিস এর সাথে পরিচয় নেই, এই সম্পদ থেকে বঞ্চিত থাকত, যদি রবীন্দ্রনাথ এই গানটি না লিখতেন।
তারপর যত রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয় বেড়েছে, তত বেশি করে তাঁর সৃষ্টিতে সেপারের প্রভাবটা চোখে পড়েছে। এই “সেপার” এর ব্যঞ্জনা কিন্তু উপরোক্ত “সেপার বাংলা” র ব্যঞ্জনার থেকে কিছুটা ভিন্ন — এখানে “সেপার” হল বাংলার বহির্বিশ্ব। রবীন্দ্রনাথ বড় হয়েছেন এপার/ওপার বাংলায়, কিন্তু নিজের সৃষ্টিকে কোন বেড়াজালে বেঁধে রাখেননি—বরং সব আগল খুলে দিয়ে নিজের সৃষ্টিতে সেপারের বাতাস, জল, ও সুগন্ধ বইতে দিয়েছেন। বোধ করি তাই তিনি বাংলার কবি থেকে বিশ্বকবি হয়েছেন আর লিখে গেছেন,
আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া॥
If you enjoyed this article please consider staying updated via RSS. Links to your own social media pages could be added here.
- Posted in LOST IN TRANSLATION
- 25 Comments